রবিবার ৭ ডিসেম্বর ২০২৫ - ২০:৪৫
হযরত উম্মুল বানীন (সা.আ.): ইমামতপ্রেম, ত্যাগ ও আদর্শিক সন্তান প্রতিপালনের মহিমান্বিত আদর্শ

বাংলাদেশ ইমামিয়া উলামা কাউন্সিলের সভাপতি হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন সাইয়্যেদ ইব্রাহিম খলিল রাজাভী বলেন— বনু কিলাব গোত্রের মর্যাদাবান নারী হযরত উম্মুল বানীন (সা.আ.) ছিলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাঁর বংশগৌরব, চরিত্রবল ও দৃষ্টিভঙ্গি হযরত আব্বাস (আ.)–সহ চার সন্তানের আত্মোৎসর্গকে আদর্শিক পরিপক্বতা দিয়েছে। তাঁর জীবনাদর্শ আজও মুসলিম সমাজে পারিবারিক শুদ্ধতা, ইমামতপ্রেম এবং সত্যের প্রতি অনড় অবস্থানের মাপকাঠি।

হাওজা নিউজ এজেন্সি’কে দেয়া হুজ্জাতুল ইসলাম ওয়াল মুসলিমিন সাইয়্যেদ ইব্রাহিম খলিল রাজাভী’র একান্ত সাক্ষাৎকারের সারসংক্ষেপ পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি:

হাওজা নিউজ এজেন্সি: হযরত উম্মুল বানীন (সা.আ.)–এর বংশ, চরিত্র ও প্রাথমিক জীবনের ইতিহাস সম্পর্কে সংক্ষেপে বলুন।

মাওলানা সাইয়্যেদ ইব্রাহিম খলিল রাজাভী: হযরত উম্মুল বানীন (সা.আ.)–এর মূল নাম ছিল ফাতিমা বিনতে হিজাম আল–কিলাবিয়া। তাঁর বংশ বনু কিলাব আরবের অন্যতম মর্যাদাবান, সাহসী ও ভাষাশুদ্ধ গোত্র হিসেবে পরিচিত। আরব ঐতিহাসিকরা যেমন ইবনে কাসীর, ইবনে আসির এবং শিয়া সূত্রগুলোতে যেমন আল–মাজলিসি, আল–ইরবিলি ও আল–কুলাইনি— সবাই উল্লেখ করেছেন যে কিলাবিদের মাঝে বীরত্ব, আনুগত্য ও কুরআনিক নৈতিকতা ছিল বিশেষ পরিচয়।

ইমাম আলী (আ.)–এর সঙ্গে তাঁর বিবাহ ছিল যথেষ্ট চিন্তাপূর্ণ ও লক্ষ্যমুখী—ইমাম (আ.) এমন পরিবার খুঁজছিলেন যাদের সন্তানরা ইমাম হুসাইন (আ.)–এর পাশে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। হযরত উম্মুল বানীন (সা.আ.) বিয়ের প্রথম দিনেই নিজের নাম ফাতিমা পরিবর্তনের অনুরোধ করেছিলেন যাতে হযরত ফাতিমা যাহ্‌রা (সা.আ.)–এর সন্তানদের মনে কষ্ট না হয়। এ আচরণ তাঁর আধ্যাত্মিক জ্ঞান, বিনয় এবং আহলে বায়তের প্রতি গভীর সম্মানের পরিচয়।

হাওজা নিউজ: তাঁর সন্তানদের প্রস্তুত করা ও কারবালার ঘটনার সঙ্গে তাঁর পরোক্ষ ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

মাওলানা ইব্রাহিম খলিল রাজাভী: হযরত উম্মুল বানীন (সা.আ.) ছিলেন চার বীর সন্তানের মা: হযরত আব্বাস (আ.), আবদুল্লাহ, জাফর ও উসমান।

শিয়া ঐতিহাসিকদের মতে, তিনি ছোটবেলা থেকেই সন্তানদের এমনভাবে লালন করেছেন যাতে তারা ইমামত ও আহলে বাইতের (আ.) সেবাকে জীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্য বলে মনে করে। হযরত আব্বাস (আ.)–এর বীরত্ব, আনুগত্য, শিষ্টাচার ও আত্মনিবেদনের যে মহিমা ইতিহাসে পাওয়া যায়—তার ভিত্তি স্থাপনকারী ছিলেন উম্মুল বানীন (সা.আ.)।

কারবালার পরে তাঁর শোকপালন ছিল রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক প্রতিবাদের এক রূপ—তিনি মদিনার বাকি কবরে প্রতিদিন কবিতা ও নওহা পাঠ করে ইয়াজিদী শাসনের বর্বরতা মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতেন। ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে যে তাঁর বিলাপ শুনে মানুষ সমবেত হয়ে ঘটনাবলি জানতে চাইত, যা কারবালা বার্তার প্রচারের অন্যতম মাধ্যম হয়ে ওঠে।

হাওজা: তাঁর চরিত্রে কোন কোন বৈশিষ্ট্য আজকের সমাজের জন্য বিশেষভাবে শিক্ষণীয়?

মাওলানা ইব্রাহিম খলিল রাজাভী: ৩টি দিক সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক—
১. পারিবারিক মূল্যবোধ ও সমন্বয়
তিনি কখনও ইমাম আলী (আ.)–এর ঘরে বিভাজন সৃষ্টি করেননি; বরং হযরত ফাতিমা যাহরা (সা.আ.)–এর সন্তানের প্রতি নিজের সন্তানদের চেয়েও গভীর ভালোবাসা দেখিয়েছেন।

২. আদর্শিক সন্তান প্রতিপালন
তিনি সন্তানদের শেখাতেন—
• সত্যের পথ ত্যাগ করা যাবে না
• ইমামের প্রতি আনুগত্য জীবনের সর্বোচ্চ শান
• সাহস, ন্যায়বোধ ও করুণা—একত্রে থাকা ঈমানের পূর্ণতা

৩. সামাজিক সচেতনতা ও প্রতিবাদ
কারবালার পরে তাঁর বিলাপ ছিল নিছক মাতৃ–শোক নয়; বরং অত্যাচারের বিরুদ্ধে নীরব বিপ্লব। আজও মুসলিম সমাজে প্রতিবাদের নৈতিক রূপ হিসেবে এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক।

হাওজা: হযরত আব্বাস (আ.)–এর চরিত্র গঠনে তাঁর শিক্ষা কীভাবে প্রভাব ফেলেছে?

মাওলানা ইব্রাহিম খলিল রাজাভী: হযরত আব্বাস (আ.)–এর মধ্যে চারটি বৈশিষ্ট্য—
• ইমামতপ্রেম
• বীরত্ব
• আত্মত্যাগ
• নৈতিক জ্যোতি
—এসব তাঁর মায়ের শিক্ষার সরাসরি ফল।

ইতিহাসে আছে, তিনি ছোটবেলায় আব্বাস (আ.)–কে ইমাম হুসাইন (আ.)–এর জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত করতেন। তিনি বলতেন—“তুমি তোমার ইমামের খাদেম হওয়ার জন্য জন্মেছ।”

কারবালার রাতে ইমাম হুসাইন (আ.)–এর প্রতি তাঁর সন্তানের আনুগত্য ছিল মায়ের দীর্ঘ শিক্ষাদানের বাস্তব প্রতিফলন।

হাওজা: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাঁর জীবনাদর্শ প্রচারের জন্য কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে?

মাওলানা ইব্রাহিম খলিল রাজাভী: বাংলাদেশে শিয়া মুসলমানদের গবেষণা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাঁর চরিত্রকে কেন্দ্র করে ৪টি উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—

১. গবেষণা ও অনুবাদ প্রকল্প: উম্মুল বানীন (সা.আ.)–এর জীবনী, শোক–সাহিত্য, ঐতিহাসিক দলিল বাংলায় অনুবাদ করা।

২. নারী উন্নয়ন ও নৈতিক শিক্ষা কার্যক্রম: শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও মসজিদ–হোসাইনিয়াগুলোতে তাঁর আদর্শ ভিত্তিক নৈতিক-পরিবারিক শিক্ষা প্রচার।

৩. কারবালা স্টাডিজ সেন্টার: কারবালার নারী চরিত্রগুলোর ভূমিকা নিয়ে একাডেমিক গবেষণার প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা।

৪. যুবসমাজের জন্য কর্মশালা: সাহস, ন্যায়, আদর্শিক জীবন, নেতৃত্ব—এসবের প্রশিক্ষণমূলক আয়োজন।

তিনি শুধু একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব নন; বরং পরিবার, সমাজ ও ধর্মীয় জীবনে আদর্শিক শুদ্ধতার এক পূর্ণাঙ্গ মডেল। তাই তাঁর চরিত্রের পরিচয় যত বিস্তৃত হবে, সমাজে তত সত্য, মানবতা ও ভ্রাতৃত্ববোধের বিকাশ ঘটবে।

Tags

আপনার কমেন্ট

You are replying to: .
captcha